BLANTERVIO103

শিবম্ অদ্বৈতং

শিবম্ অদ্বৈতং
Saturday, February 22, 2020
“শিবমদ্বৈতং” বাক্যটি মূল শ্রুতি মাণ্ডুক্য উপনিষদের ৭ নং মন্ত্রে উল্লেখিত।

শিবম্ অদ্বৈতং = শিব অদ্বৈত অর্থাৎ শিব ব্যাতীত দ্বিতীয় কিছু নেই। একমাত্র শিবই সত্য। প্রথমে আমরা মূল শ্রুতিটা দেখে নেব-

নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিঃপ্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রাজ্ঞম্। অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণমচিন্ত্যম্ অব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে। স আত্মা। স বিজ্ঞেয়ঃ।। (মাণ্ডুক্য ৭)

অনুবাদঃ যিনি তৈজস নহেন, বিশ্বজগৎ নহেন, স্বপ্ন ও জাগরণের মধ্যবর্তী নহেন, প্রাজ্ঞ নহেন, যুগপৎ সর্ববিষয়ের জ্ঞাতা নহেন, জড় নহেন, যিনি অদৃশ্য, অব্যবহার্য, অগ্রাহ্য, অননুমেয়, অচিন্ত্য, অনির্দেশ্য, যিনি কেবল ‘আত্মা’ এই প্রতীতির গম্য, যিনি জগৎ সংসারের বিরামস্বরূপ, শান্ত, শিব ও অদ্বৈত, তাকেই বিবেকীরা চতুর্থ মনে করে থাকেন। তিনিই আত্মা, তিনিই বিজ্ঞেয়। (মাণ্ডুক্য উপঃ ৭)

বিশ্লেষণঃ উপনিষৎ এখানে দৃশ্যমান জগৎ, জড় বস্তু এবং ব্যবহারিক সত্তাকে অগ্রাহ্য বলেছে। অর্থাৎ পারমার্থিক জ্ঞানে জড় দৃশ্যমান জগৎ প্রপঞ্চ এর গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। শ্রীমৎ শংকরাচার্য এই তত্ত্বকে রজ্জুতে সর্পভ্রম বলে ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। আমরা উপরের শ্রুতি হতে দেখতে পাই শিবকেই অদ্বৈত বলা হয়েছে। যদি শিবই সমস্ত হয় তাহলে আবার তিনি জড় নন কিংবা তিনি বিশ্বজগৎ নহেন কিংবা তিনি দৃশ্যমান নন তথা অগ্রাহ্য এই সকল উক্তি পরষ্পরের বিরুদ্ধ নয় কি??

বৈষ্ণবাচার্যগণ এমনই দাবী উত্থাপন করে আচার্য্য শংকরের মতবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাদের দাবী যদি সবই ব্রহ্ম হয় তাহলে জগৎ মিথ্যা কি করে হয়? যদি ব্রহ্ম বহু রূপে রূপায়িত হয় তবে সেই ব্রহ্ম কেবলই নির্গুণ /নিরাকারই কেন? শংকরাচার্য ব্রহ্মকে নির্বিশেষ, নির্গুণ ও নিরাকার হিসেবেই গ্রহণ করেছেন। এবং সেই ব্রহ্মেরই সগুণ প্রকাশ ও সৃষ্টিকে মায়া দ্বারা আখ্যায়িত করেছেন তথা কার্য্যব্রহ্ম বা হিরণ্যগর্ভ।

বৈষ্ণবাচার্যগণ এর দাবী এখানে মূল শ্রুতিতেই খন্ডিত আছে। অতএব শিবই সমস্ত হলেও তিনি জড় নন, জগৎ নন, দৃশ্যমান নন, গ্রাহ্য নন ইহা পরষ্পর বিরুদ্ধ কেবল বৈষ্ণবাচার্যগণ এর নিকটই হতে পারে। আমাদের নিকট এরূপ সন্দেহ নাই। কারণ আমরা সরাসরি মূল শ্রুতিকে অনুসরণ করেই এটি গ্রহণ করেছি।

চতুষ্পাদ আত্মার তুরীয় অবস্থাকেই চতুর্থ বা শান্ত শিবাবস্থা বলা হয়। ভ্রান্তিবশতঃ রজ্জুতে সর্প, দণ্ড এবং জলাধার কল্পিত হলে সেই তিনে অনুস্যূত রজ্জুকে যে অর্থে চতুর্থ বলা যায় সেই অর্থে অবিদ্যা-কল্পিত পাদত্রয়ে অনুস্যূত পরমাত্মাকে তুরীয় (চতুর্থ) বলা হয়। সহজ কথায় একটা পাত্রকে ভ্রমবশত তিনটে রূপে দেখা হল যথাঃ সাপ, লাঠি, জলাধার। এখানে তিনটি কল্পিত বস্তু দেখা সত্ত্বেও মূল পাত্রটি অজ্ঞাত। সেহেতু সেই অজ্ঞাত পাত্রটিই চতুর্থ অর্থাৎ সেটাই হল পরম সত্য (পরমাত্মা)। উপরের মূল শ্রুতিতে শিবকে চতুর্থ কেন বলা হয়েছে আশা করি বুঝতে পেরেছেন।

এখন প্রশ্ন শিব অদ্বৈত হলে বাকি তিন পাদ তথা জাগরণ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি কি শিব হতে ভিন্ন? যদি ভিন্ন হয় তাহলে অদ্বৈত যুক্তি কি খন্ডিত হয় না?

তার উত্তরে আমি বলব না। এমনটা নয়। এখানেও তৈজস (স্বপ্ন অবস্থায় ব্যাষ্টিত প্রাণী) ও হিরণ্যগর্ভের ঐক্য আছে। জাগরণ, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি -এই তিন অবস্থাই নিদ্রা; জীব তিন অবস্থাতেই নিদ্রিত। কারণ সর্বত্রই তত্ত্বের অনুভূতির অভাব আছে। জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থাতে আরও অধিক দোষ এই যে, উহাতে মূল বাস্তবিক সত্যতা উপলব্ধি হয় না। জাগ্রত ও স্বপ্নে অনুভূত মনের বিক্ষিপ্ত রূপ দ্বৈতসমূহ সেখানে কারণের সাথে মিলিত হওয়ায় ভেদ অনুভূত হয় না। (কার্য্য সর্বদা কারণ এর সাথে জুড়ে থাকে। যেমন সূর্য রশ্মি সূর্য হতে ভিন্ন নয়)

পূর্বের ন্যায় এখানেও জীব ও ব্রহ্মের অভেদভাব বুঝতে হবে। কারণ মান্ডুক্য উপনিষদ ৫ নং মন্ত্রে “সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ ” এই বাক্যে স্পষ্ট। অর্থাৎ সর্ব বিক্ষিপ্ততা নাশ হলে একতাপ্রাপ্ত হয়। যতক্ষণ দৃশ্যমান জগৎ প্রপঞ্চের উপশম হবে না, যতক্ষণ জড় বস্তু দৃশ্যমান এবং যতক্ষণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য বস্তু উপলব্ধি ততক্ষণে যে আপাত বিরোধ উহা যে সত্য নয় একমাত্র চতুর্থ অবস্থা তথা সদাশিব (পরমাত্মাই) একমাত্র সত্য ইহাই এই শ্রুতির আলোচ্য বিষয়। অতএব ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যেতি বাক্য পরমার্থতঃ গ্রাহ্যম্।

মাণ্ডুক্য শ্রুতির ১২ নং মন্ত্র দ্বারা আমি আলোচনা সমাপ্ত করছি।

অমাত্রশ্চতুর্থোহব্যবহার্যঃ প্রপঞ্চোপশমঃ শিবহ্দ্বৈত এবমোঙ্কার আত্মৈব। সংবিশত্যাত্মনাত্মানং য এবং বেদ, য এবং বেদ।।

অনুবাদঃ এইভাবে যথা উক্ত জ্ঞানীর দ্বারা অবশেষে মাত্রাহীন ওঁকার তুরীয়, ব্যবহারের অতীত, জগতের সমাপ্তি, মঙ্গলময় (শিবময়), অদ্বৈত আত্মরূপেই পর্যবসিত হয়। যিনি এরূপ জানেন তিনি তৎক্ষনাৎ পরমাত্মায় বিলীন হন।

অর্থাৎ রজ্জুতে যে সর্পভ্রম হয় রজ্জুই সেই সর্পের নিবৃত্তিস্থল। রজ্জুকে রজ্জু জানলে সর্প নামক ভ্রম আর থাকে না অর্থাৎ উহা রজ্জুতেই বিলীন হয়। বাচ্য ও বাচক ক্রমে লীন হওয়ায় বাক্য ও মনের অতীত।

অতএব ব্রহ্ম নির্বিশেষ, নির্গুণ, নিরুপাধিক, বাক্য মনের অতীত, দৃশ্যমান জগতের অতীত, অগ্রাহ্য, অদ্বৈত, পরম সত্য তুরীয়। ইহাই সর্ববেদান্ত সিদ্ধান্ত।

ওঁ নমঃ শিবায়।

ওঁ

Written by Joy Biswas
Share This Article :

TAMBAHKAN KOMENTAR

7599550894000336510