BLANTERVIO103

শিব ও কৃষ্ণের যুদ্ধে শিব পরাজয়ের উক্তির খন্ডন

শিব ও কৃষ্ণের যুদ্ধে শিব পরাজয়ের উক্তির খন্ডন
Monday, February 10, 2020
সুধী সনাতনী, সম্প্রতি কৈষ্ণব সম্প্রদায় মহাভারতের তথ্য দিয়ে জোরালো ভাবে প্রচার করছেন যে, শিব ও কৃষ্ণনের যুদ্ধে শিব কৃষ্ণনের কাছে পরাজিত হয়েছেন!! এছাড়া এই তথ্য নিয়ে বিভিন্ন সনাতনী গ্রুপের মধ্যে কৈষ্ণব সম্প্রদায় ও শৈব সম্প্রদায় তর্কবিতর্ক লেগেই আছে।

যে মহাভারত তথা সনাতনী বিভিন্ন শাস্ত্রের ও গ্রন্থের মধ্যে বলা হচ্ছে যে, বিষ্ণু হতে শুরু করে বিষ্ণুর প্রত্যেক অংশ অবতার এই দেবাদিদেব মহাদেবের উপাসক ছিলেন, সেখানে মহাভারতে এই ধরনের কথা কেমনে থাকে!! হ্যাঁ, এই কথা সত্য যে, শিব ও কৃষ্ণনের যুদ্ধে শিব পরাজয়ের গ্লানি নিয়েছেন!! কিন্তু স্বয়ং প্রভু হয়ে এইভাবে কেমনে পরাজিত হতে পারে?

আসলে এর উত্তর সেই মহাভারতের মধ্যেই বিদ্যমান, আর কৈষ্ণব সম্প্রদায়ের উপস্থাপন করা সেই উক্তি আজ খন্ডন করছি। যথারীতি আমরা সবাই জ্ঞাতব্য যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে মিথ্যা বলিয়ে দ্রৌণ হত্যা করেছিলেন! তথা যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, "অশ্বত্থামা হত ইতি গজ"

লম্বায় না গিয়ে সংক্ষেপে শেষ করছি, দ্রৌণ হত্যার পর দ্রৌণপুত্র অশ্বত্থামা নিজের ক্রোধ সংরক্ষণ করতে না পেরে পান্ডব সৈন্যদের উপর তথা কৃষ্ণ ও অর্জুনের উপরে লক্ষ্যে করে একটি আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগ করেন!! যে আগ্নেয়াস্ত্র কুরুক্ষেত্রের ময়দানে পান্ডব সৈন্যদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়।

তা দেখে, কৌরব সৈন্যদলের সবাই আনন্দিত হয়ে উঠে এবং জয়ের উল্লাসে মেতে উঠেন!! কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সবাই দেখেন যে, সেই আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে হতে কৃষ্ণ ও অর্জুন বেরিয়ে আসছে!! তাও আবার সম্পূর্ণরূপে অক্ষত অবস্থায়, ঠিক যেভাবে চন্দ্র ও সূর্য মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তখন সে দৃশ্য দেখে দ্রৌণপুত্র অশ্বত্থামা হতবাক হয়ে যায় এবং দৈবাস্ত্রকে ধিক্কার জানাই।

অশ্বত্থামা বলেন এ সব মিথ্যা, এ অসম্ভব, এই অস্ত্র মিথ্যা কেমনে হতে পারে, এই ধরনের কথা বলতে বলতে অশ্বত্থামা ধনুর্বাণ ত্যাগ করে যুদ্ধস্থল চলে যাচ্ছেন।

সনাতনী সুধী, আমি ঠিক সেখান থেকে শ্লোক ও বঙ্গানুবাদ দিয়ে শুরু করছি, সেই তথ্যটি হচ্ছে, মহাভারতের (দ্রৌণপর্ব-একাধিকদ্বিশততমোহধ্যায়ঃ)

ততো দ্রৌণির্ধনুস্তক্ত্বা রথাৎ প্রস্কন্দ্য বেগিতঃ।
ধিগ্ ধিক্ সর্ব্বমিদং মিথ্যেতুক্ত্বা সংপ্রাদবদ্রণাৎ।।৪৭
অনুবাদ:- তাহার পর অশ্বত্থামা ধনু ত্যাগ করিয়া রথ হইতে বেগে অবতীর্ণ হইয়া ধিক্ ধিক্ এ সমস্তই মিথ্যা, এই কথা বলিয়া রণস্থল হইতে দ্রুত প্রস্থান করিলেন।

ততঃ স্নিগ্ধাম্ভুদাভাসং বেদাবাসমকল্মষম্।
বেদব্যাসং সরস্বত্যাবাসং ব্যাসং দদর্শ হ॥৪৮
অনুবাদ:- তদন্তর তিনি স্নিগ্ধ মেঘের ন্যায় শ্যাম কান্তিধারী, বেদ ও সরস্বতীর আবাসস্থান তথা বেদের বিস্তারকারী পাপশূণ্য মহর্ষি ব্যাসকে সেখানে দেখতে পেলেন।

তং দ্রৌণিরগ্রতাে দৃষ্ট্বা স্থিতং কুরুকুলোদ্বহ!।
সন্নকণ্ঠোহব্রবীদ্বাক্যমভিবাদ্য সুদীনবৎ॥৪৯
অনুবাদ:- কুরুকুল শ্রেষ্ঠ! বেদব্যাসকে সামনে দেখে দ্রৌণকুমারের গলা অশ্রুসিক্তে ভরে এলো। অশ্বত্থামা অত্যন্ত নতভাবে প্রণাম করে বেদব্যাসকে এইপ্রকারে জিজ্ঞাসা করিলেন।

ভাে ভাে মায়া যদৃচ্ছা বা ন বিদ্ম কিমিদং ভবেৎ।
অস্ত্রং ত্বিদং কথং মিথ্যা মম কশ্চ ব্যতিক্রমঃ॥৫০
অনুবাদ:- মহর্ষি! এটা কি মায়া, না- দৈবইচ্ছা! আমার বুদ্ধিতে আসছে না এটা কি? এই অস্ত্র মিথ্যা কেমনে হলো? আমার কি কোনো ত্রুটি হইল?

অধরোত্তরমেতদ্বা লােকানাং বা পরাভবঃ।
যদিমৌ জীবতঃ কৃষ্ণো কালাে হি দুরতিক্রমঃ॥৫১
অনুবাদ:- এই আগ্নেয়াস্ত্রের প্রভাব বিপরীত হইল অথবা সমস্ত লোকের পরাভব দিলেন, যা এই দু'জন জীবিত বেঁচে গেলেন! নিশ্চয়ই কালের উল্লঙ্ঘন করা অত্যন্ত কঠিন।

নাসুরা ন চ গন্ধর্বা ন পিশাচা ন রাক্ষসাঃ।
ন সর্পযক্ষপতগা ন মনুষ্যাঃ কথঞ্চন।৫২
তদিদং কেবলং হত্বা শান্তমক্ষৌহিণীং জ্বলৎ।
উৎসহন্তেহন্যথা কর্ত্তুমেতদস্ত্রং ময়েরিতম্॥৫৩
অনুবাদ:- আমার দ্বারা নিক্ষিপ্ত করা এই অস্ত্রের
অসুর, গন্ধর্ব, পিশাচ, রাক্ষস, সর্প, যক্ষ, পক্ষী ও মনুষ্যেরা কোনো প্রকারেই ব্যর্থ করিতে সমর্থ হয় না। তারপরেও এই প্রজ্বলিত অস্ত্র কেবল এক অক্ষৌহিণী সৈন্য জ্বালিয়ে শান্ত হয়ে গেল।

সর্ব্বঘাতি ময়া মুক্তমস্ত্রং পরমদারুণম্॥
কেনেমৌ মর্ত্যধৰ্ম্মাণৌ নাবধীৎ কেশবাৰ্জ্জুনৌ।৫৪
অনুবাদ:- আমি তো অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও সর্ব্বসংহারক অস্ত্র  নিক্ষিপ্ত করেছি, কিন্তু এই অস্ত্র কোন্ কারণে এই মত্যধর্মা কৃষ্ণ ও অর্জুনের বধ করল না?

এতৎ প্রব্রুহি ভগবন! মযা পৃষ্টৌ যথাতথম্।
শ্রোতুমিচ্ছামি তত্ত্বেন সৰ্ব্বমেতন্মহামুনে।।৫৫
অনুবাদ:- ভগবান মহামুনে! আমি যে আপনাকে এই প্রশ্ন করলাম, তাঁর যথার্থ উত্তর দিন। আমি এর ঠিক ঠিক উত্তর শুনতে ইচ্ছা করি।

ব্যাস উবাচ

মহান্তমেতমর্থং মাং যং ত্বং পৃচ্ছসি বিস্ময়াৎ।
তং প্রবক্ষ্যামি তে সৰ্ব্বং সমাধায় মনঃ শৃণু॥৫৬
অনুবাদ:- বেদব্যাস বলিলেন- অশ্বত্থামা, তুমি বিস্ময়বশতঃ এই যে উত্তম বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছ, আমি সেই সমস্তই বলিব, তুমি মনোনিবেশ করিয়া শ্রবণ কর।

যহসৌ নারায়ণো নাম পূর্বেষামপি পূর্বজঃ।
অজায়ত চ কার্য্যার্থং পুত্রো ধর্ম্মস্য বিশ্বকৃৎ।৫৭
অনুবাদ:- যিনি আমাদের পূর্ব্বজেরও পূর্ব্বজ ভগবান নারায়ণ, সেই বিশ্ববিধাতা ভগবান এক সময় কোনো এক বিশেষ কার্য হেতু ধর্ম্ম পুত্ররূপে অবতীর্ণ হয়েছিল।

স তপস্তীব্রমাতস্থে শিশিরং গিরিমাস্থিত।
উৰ্দ্ধবাহুর্মহাতেজা জ্বলনাদিত্যসংনিভঃ।।৫৮
অনুবাদ:- অগ্নি ও সূর্যের সমান মহাতেজস্বী সেই ভগবান নারায়ণ হিমালয় পর্বতের উপরে গিয়ে নিজের দুই বাহু উপরে তুলে কঠোর তপস্যা করছিলেন।

পষ্টিং বর্ষসহস্রাণি তাবন্ত্যেব শতানি চ।
অশোপয়ত্তদাত্মানং বাযুভক্ষোহম্বূজেক্ষণঃ॥৫৯
অনুবাদ:- সেই কমলনয়ন শ্রীহরি ছয়ষট্টি হাজার বছর পর্যন্ত কেবল বায়ু ভক্ষণ করে সেদিনই নিজের শরীরের সুস্বায়া করেন।

অথাপরং তপস্তপ্ত্বা দ্বিস্ততােহন্যৎ পুনমহৎ।
দ্মাবাপৃথিব্যোবিবরং তেজসা সমপূয়রৎ॥৬০
অনুবাদ:- তদন্তর তার চেয়ে দ্বিগুণ কাল পর্যন্ত ভারী তপস্যা করে তিনি নিজের তেজে পৃথিবী আর আকাশের মধ্যবর্তী আকাশ ভরে দিয়েছিলেন।

স তেন তপসা তাত ব্ৰহ্মভূতাে যদাভবৎ।
তদা বিশ্বেশ্বরং যােনিং বিশ্বস্য জগতঃ পতিম্॥৬১
দদর্শ ভৃশদুর্ধর্শং সর্বদেবৌরভিষ্টুতম।
অণীয়াং সমণুভ্যশ্চ বৃহদ্ভ্যশ্চ বৃহত্তমম্।।৬২
অনুবাদ:- তখন সেই তপস্যাতে উনি সাক্ষাৎ ব্রহ্মস্বরূপে স্থিত হয়ে গেলেন, তখন উনাকে সেই ভগবান বিশ্বেশ্বরের দর্শন হয়েছে যিনি সম্পূর্ণ বিশ্বের উৎপত্তিস্থান ও জগতের পালক, যাঁকে পরাজিত করা অত্যন্ত কঠিন ও অসম্ভব। সমস্ত দেবতা যাঁর স্তুতি করে থাকেন যিনি সুক্ষ্মের চেয়েও অতি সূক্ষ্ম এবং মহানের চেয়েও পরম মহান।

রুদ্রমীশানবৃষভং হরং শম্ভুং কপর্দিনম্।
চেকিতানং পরাং যােনিং তিষ্ঠতো গচ্ছতশ্চ হ॥৬৩
অনুবাদ:- তিনি 'রু' অর্থাৎ দুঃখ দূর করার কারণে রুদ্র নামে অভিহিত। ব্রহ্মাদি লোকপালের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ যিনি। যিনি পাপহারী, কল্যাণকারী তথা জটাজুটধারী। উনিই সবাইকে চেতনা প্রদান করেন এবং উনিই স্থাবর-জঙ্গম প্রাণীদের পরম কারণ।

দুর্বারণং দুর্ধশং তিগ্মমন্যুং মহাত্মানং সর্বহরং প্রচেতসম্।
দিব্যং চাপমিষুধী চাদদানং হিরণ্যবর্ম্মাণমনন্তবীর্য্যম্॥৬৪
অনুবাদ:- উনাকে কেউ কোথাও স্তব্ধ করতে পারে না, উনার দর্শন অনেকটাই দুর্লভ, যিনি দুষ্টের উপর প্রচন্ড ক্রোধী, যাঁর হৃদয় বিশাল, যাঁকে সকল ক্লেশ হরণকারী বা সংহারকারী বলা হয়, সাধুপুরুষের প্রতি যাঁর হৃদয় অত্যন্ত উদার হয়, যিনি দিব্য ধনু ও তরকস ধারণ করেন, যাঁর কবচ স্বর্ণের হয়ে থাকে তথা উনি অত্যন্ত বল- পরাক্রমে পরিপূর্ণ।

পিনাকিনং বজ্রিণং দীপ্তশূলং পরশ্বধিনং গদিনঞ্চায়তাসিম্।
শুভ্রং জটিলং মূসলিনং চন্দ্রমৌলিং ব্যাঘ্রাজিনং পরিঘিণং দণ্ডপাণিম্।।৬৫
অনুবাদ:- উনি নিজের হাতে পিনাক ও বজ্র ধারণ করেন, উনার এক হাতে ত্রিশূল জোতির্ময় থাকেন, উনি ফরসা, গদা ও লম্বা তরবারি নিয়ে থাকেন, মুসল, পরীঘ ও দণ্ড যাঁর হাতের শোভা বাড়ায়, উনার অঙ্গকান্তি উজ্জ্বল, যিনি মস্তকে জটা ও তার উপরে চন্দ্রিমার মুকুট ধারণ করেন, যাঁর শ্রীঅঙ্গে বাঘম্বর শোভা পায়।

শুভাঙ্গদং নাগযজ্ঞােপবীতং বিশ্বৌৰ্গণৌঃ শােভিতং ভূতসঙ্ঘৌ।
একীভূতং তপসাং সন্নিধানং বযোতিগৌ সুষ্টুতমিষ্টবাগ্ভিঃ।।৬৬
অনুবাদ:- উনার বাহুতে সুন্দর অঙ্গত ও গলায় নাগময় যজ্ঞোপবীত শোভা পায়, যিনি নিজের পার্ষদস্বরূপে সম্পূর্ণ ভূতসমুদায়ে সুশোভিত, উনাকেই একমাত্র ও অদ্বিতীয় পরমেশ্বর সম্বোধন করা হয়, উনিই তপস্যার নিধি এবং দিব্য পুরুষ প্রিয় বাক্যদ্বারা উনার স্তুতি করে থাকেন।

জলং দিশং খং ক্ষিতিং চন্দ্ৰসুৰ্য্যৌ তথা বাযুগ্নী প্রমিমাণং জগচ্চ।
নালং দ্রষ্টুং যং জনা ভিন্নবৃত্তা ব্ৰহ্মদ্বিষঘ্নমমৃতস্য যােনিম্॥৬৭
অনুবাদ:- নল, দিশা, আকাশ, পৃথিবী, চন্দ্রিমা, সূর্য, বায়ু, অগ্নি তথা জগতের মাপ নেওয়ার কাল- এইসব উনার স্বরূপ। উনি ব্রহ্মদ্রোহীদের নাশক ও মোক্ষপ্রাপ্তির পরম কারণ, দুরাচারী মনুষ্য উনার দর্শন প্রাপ্ত হতে পারেন না।

যং পশ্যন্তি ব্রাহ্মণাঃ সাধুবৃত্তাঃ ক্ষীণে পাপে মনসা বীতশােকাঃ।
তং নিষ্পতন্তং তপসা ধম্মমীভ্যং তদ্ভক্ত্যা বৈ বিশ্বরূপং দদর্শ।
দৃষ্ট্বা চৈনং বাঙ্মনােবুদ্ধিদেহৈঃ সংহৃষ্টাত্মা মুমুদে বাসুদেবঃ।।৬৮
অনুবাদ:- যাঁরা মন থেকে সর্বদা শোক-সন্তাপ দূরীভূত করে দেন, সেই সদাচারী ব্রাহ্মণের পাপের ক্ষয় হওয়ার পর যাঁর দর্শন করতে পারেন, এই সম্পূর্ণ বিশ্ব যাঁর স্বরূপ, যিনি সাক্ষাৎ ধর্ম তথা স্তব করার যোগ্য পরমেশ্বর, সেই মহেশ্বর সেখানে উনার ভক্তির প্রভাবে প্রকট হয়ে গেলেন তখন তপস্বী নারায়ণ উনার দর্শন করলেন। উনার দর্শন করে মন, বাণী, বুদ্ধি ও শরীরের সাথে উনার অন্তরআত্মা হর্ষবর্ধন হয়ে উঠে, তখন ভগবান বাসুদেব অনেক আনন্দ অনুভব করেন।

অক্ষমালাপরিক্ষিপ্তং জ্যোতিষাং পরমং নিধিম্।
ততো নারায়ণাে দৃষ্ট্বা ববন্দে বিশ্বসম্ভবম্॥৬৯
অনুবাদ:- রুদ্রাক্ষ মালাতে বিভূষিত জোতির্ময় পরম নিধিরূপ সেই বিশ্ব-বিধাতার দর্শন করে, ভগবান নারায়ণ উনার বন্দনা করেন।

বরং পৃথুচার্বঙ্গ্যা পার্বত্যা সহিতং প্রভুম্।
ক্রীড্যমানং মহাত্মানং ভূতসঙ্ঘগণৈর্বৃতম্॥৭০
অজমীশানমব্যক্তং কারণাত্মানচ্যুতম্।
অনুবাদ:- সেই বরদায়ক প্রভু হৃষ্টপুষ্ট এবং মনোহর অঙ্গাধীকারী পার্বতী দেবীকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হলেন, সেই অজন্মা, দর্শন অব্যক্ত, কারণস্বরূপ এবং নিজের মহিমা থেকে কখনও চ্যুত হয় না সেই পরমাত্মাকে উনার পার্ষদস্বরূপ ভূতগণেরা ঘিরে রেখেছিলেন।

অভিবাদ্মাথ রুদ্ৰায় সদ্মোৎন্ধকনিপাতিনে।
পদ্মাক্ষস্তং বিরূপাক্ষমভিতুষ্টাব ভক্তিমান্‌।।৭১
অনুবাদ:- কমলনয়ন ভগবান শ্রীহরি পৃথিবীপর দুই হাঁটু ঠেকে এবং মস্তকোপর দুই হাত জোড় করে অন্ধকাসুরের বিনাশকারী সেই রুদ্রদেবকে প্রণাম করেন এবং ভক্তিভাবে যুক্ত হয়ে ভগবান বিরূপাক্ষকে নারায়ণ এই প্রকারে স্তুতি করা শুরু করলেন।

নারায়ণ উবাচ

ত্বৎসম্ভুতা ভূতকৃতো বরেণ্য! গােপ্তারোহস্য ভুবনস্যাদিদেব।
আবিশ্যেমাং ধরণীং যেহভ্যরক্ষন্ পুরা পুরাণীং তব দেব! সৃষ্টিম্॥৭২
অনুবাদ:- নারায়ণ বললেন, সর্বশ্রেষ্ঠ আদিদেব, যিনি এই পৃথিবীতে এসে পুরাতন সৃষ্টির রক্ষা করেছিলেন তথা যে এই বিশ্বের রক্ষা করবেন, যিনি সম্পূর্ণ প্রাণীলোকের সৃষ্টি করবেন প্রজাপতিগণ আপনার থেকে সৃষ্টি হয়েছেন।

সুরাসুরান্নাগরক্ষঃপিশাচান্নরান্ সুপর্ণানথ গন্ধর্বযক্ষান্।
পৃথগ্বিধান্ ভূতসঙ্ঘাংশ্চ বিশ্বাস্ত্বস্তসম্ভুতান্ বিদ্ম সর্বাংস্তথৈব।
ঐন্দ্রং যাম্যং বারুণং বৈত্তপাল্যং পৈত্ৰং ত্বাষ্টং কৰ্ম্ম সৌম্যঞ্চ তুভ্যম্॥৭৩
অনুবাদ:- দেবতা, অসুর, নাগ, রাক্ষস, পিশাচ, মনুষ্য, গরুড়াদি পক্ষী, গন্ধর্ব তথা যক্ষাদি পৃথক পৃথক প্রাণীদের অস্বিল সমুদায় বিরাজমান, সেইসব ও আমি আপনার থেকে সৃষ্টি। সেই প্রকার ইন্দ্র, যম, বরুণ, এবং কুবেরের পদ, পিতৃপুরুষের লোক তথা বিশ্বকর্মার সুন্দর শিল্পকর্মের আবির্ভাব আপনার থেকেই হয়েছে।

রূপং জ্যোতিঃ শব্দ আকাশ বায়ুঃ স্পর্শ স্বাদ্মং সলিলং গন্ধ উৰ্ব্বী।
কালাে ব্রহ্মা ব্ৰহ্ম চ ব্রাহ্মণাশ্চ ত্বৎসম্ভূতং স্থাস্নু চরিষ্ণু চেদম্॥৭৪
অনুবাদ:- শব্দ ও আকাশ, স্পর্শ ও বায়ু, রূপ ও তেজ, রস ও জল তথা গন্ধ ও পৃথিবীর সৃষ্টি আপনার থেকে হয়েছে। কাল, ব্রহ্মা, বেদ, ব্রাহ্মণ তথা এই সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ আপনার থেকে সৃষ্টি হয়েছে।

অদ্ভ্যঃ স্তোকা যান্তি যথা পৃথক্ত্বং তাভিশ্চৈক্যং সংক্ষয়ে যান্তি ভূয়ঃ।
এবং বিদ্বান্ প্রভং চাপ্যয়ং চ মত্বা ভূতানাং তব সাযুজ্যমেতি॥৭৫
অনুবাদ:- যেভাবে জলের মধ্যে তাঁর কণাবিন্দু বিলগ্নিকরণ হয় ক্ষীণ হওয়ায় কালক্রমে তা পুনরায় জলে মিলে তাঁর সাথে একরূপ হয়ে যায়, সেই প্রকার সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড আপনার থেকে সৃষ্টি হয় এবং আপনার কাছেই লীন হয়ে যায়। এই জ্ঞান ধারণকারী বিদ্বান পুরুষ আপনার সাযুজ্য প্রাপ্তি করে থাকেন।

দিব্যাবৃতৌ মানসৌ দ্বৌ সুপর্ণৌ বাচঃ শাখাঃ পিপ্পলা সপ্ত গােপাঃ।
দশাপ্যন্যে তৌ পুরং ধাবয়ন্তি ত্বযা সৃষ্টাস্ত্বং হি তেভ্যঃ পরাে হি॥৭৬
অনুবাদ:- অন্তঃকরণে নিবাসকারী দুই দিব্য অমৃত স্বরূপ ঈশ্বর ও জীব। সাথে ধাতুরূপ সাথে পিপলও, যা তাঁদের রক্ষা করে। দৈববাণী সেই বৃক্ষের শাঁখা। দ্বিতীয়ত দশ বাস্তুতে তথা দশ ইন্দ্রিয়, যা পাশ্চভৌতিক শরীররূপী নগরের ধারণ করেন। সেইসব পদার্থের রচয়িতা স্বয়ং আপনি, তথাপি আপনি এইসবের উর্দ্ধে।

ভূতং ভব্যং ভবিতা চাপ্যধৃব্যং ত্বৎসম্ভুতা ভুবনানীহ বিশ্বা।
ভক্তঞ্চ মাং ভজমানং ভজস্ব মা রীরিষাে মামহিতাহিতেন॥৭৭
অনুবাদ:- ভুত, বর্তমান, ভবিষ্য তথা অজেয় কাল- এইসব আপনারই স্বরূপ। সেখানকার সম্পূর্ণ লোক আপনার থেকে সৃষ্টি হয়েছে। আমি আপনার ভজনকারী ভক্ত হই, আপনি আমায় গ্রহণ করুন। হে মঙ্গলকারী গ্রহণ করুন আমায় হিংসা করবেন না।

আত্মানং ত্বামাত্মনােহনন্যবোধং বিদ্বানেবং গচ্ছতি ব্ৰহ্মশুক্রম্।
অস্তৌষং ত্বাং তব সম্মানমিচ্ছন্ বিচিন্বন্ বৌ সদৃশং দেববর্য্য!।
সুদুর্লভান্ দেহি বরান্মমেষ্টানভিষ্টুতঃ প্রতিকার্ষীশ্চ মায়াম্॥৭৮
অনুবাদ:- আপনি জীবাত্মা থেকে অভিন্ন অনুভবকারী জ্ঞানীর আত্মা স্বরূপ, এইরকম জ্ঞানকারী বিদ্বান পুরুষ বিশুদ্ধ ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত করেন। দেবর্ব্য! আমি আপনার সৎকার শুভ ইচ্ছা নিয়ে এই স্তব করছি। স্তুতির সর্বদা যোগ্য হে পরমেশ্বর আমি চিরকালই আপনার অন্বেষণ করে যাচ্ছি। যাঁর উপযুক্ত স্তুতি জ্ঞাপন করছি ঠিক এইভাবে আপনি আপনার মায়াকে দূর করে আমায় অভীষ্ট বরদান প্রদান করুন।

ব্যাস উবাচ

তস্মৈ বরানচিন্ত্যাত্মা নীলকণ্ঠঃ পিনাকধৃত্।
অর্হতে দেবমুখ্যায় প্রাযচ্ছদৃষিসংস্তুতঃ॥৭৯
অনুবাদ:- ব্যাসদেব বলিলেন, দ্রৌণকুমার, নারায়ণ ঋষির এই প্রকারে স্তুতি করার পর অচিন্তস্বরূপ, পিনাকধারী, নীলকন্ঠ ভগবান শিবজি বর প্রাপ্তির সর্বথা যোগ্য সেই দেবপ্রধান নারায়ণকে অনেক বর প্রদান করেন।

শ্রীভগবান উবাচ

মৎপ্রসাদন্মনুষ্যেষু দেবগন্ধৰ্ব্বযোনিষু।
অপ্রমেষবলাত্মা ত্বং নারায়ণ! ভবিষ্যসি।।৮০
অনুবাদ:- শ্রীভগবান বললেন, নারায়ণ! তুমি আমার কৃপাপ্রসাদে মনুষ্য, দেবতা তথা গন্ধর্বেতেও অসীম বল-পরাক্রমশালী হবে।

ন চ ত্বাং প্ৰসহিষ্যস্তি দেবাসুরমহােরগাঃ।
ন পিশাচা ন গন্ধৰ্ব্বা ন যক্ষা ন চ রাক্ষসাঃ॥৮১
ন সুপর্ণাস্তথা নাগা ন চ বিশ্বে বিযোনিজা।
ন কশ্চিত্ত্বাঞ্চ দেবোহপি সমরেহপু বিজেষ্যতি।।৮২
অনুবাদ:- দেবতা, অসুর, বড় বড় সর্প, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, সুপর্ণ নাগ তথা সমস্ত পশু(সিংহ, বাঘ্রাদি) প্রাণীগণ তোমার বেগ সহ্য করতে পারবে না। যুদ্ধস্থলে কোনো দেবতা তোমাকে পরাজিত করতে পারবে না।

ন শস্ত্রেণ ন বজ্রেণ নাগ্নিনা ন চ বায়ুনা।
ন চাদ্রেণ ন শুষ্কেণ ত্ৰসেন স্থাবরেণ চ॥৮৩
কশ্চিত্তব রুজাং কর্ত্তা মৎপ্রসাদাৎ কথঞ্চন।
#অপি_বৈ_সমরং_গত্বা_ভবিষ্যসি_মমাধিক্।।৮৪
অনুবাদ:- শস্ত্র, বজ্র, অগ্নি, বায়ু, ভেজা-শুষ্ক পদার্থ ও স্থাবর এবং জঙ্গম প্রাণীমধ্যেও কেউ আমার কৃপাপ্রসাদে কোনোভাবেই তোমায় আঘাত বা ক্ষতি করতে পারবে না। #তুমি_পৃথিবীতে_আবির্ভাব_হওয়ার_পর_স্বয়ং_আমার_থেকেও_অধিক_বলবান_হয়ে_যাবে।

সুধী সনাতনী, ৮৪তম শ্লোকে স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবানের মহাদেব নিজ মুখে বলছেন যে, নারায়ণ, তুমি পৃথিবীতে আবির্ভাব তথা জন্ম নেওয়ার পর স্বয়ং আমার (মহাদেবের) থেকেও অধিক বলবান অর্থাৎ শক্তিশালী হবে!!!

তাহলে এখানে বুঝতে হবে যে, স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবানের শিব যখন ভক্ত নারায়ণের ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে বরদান দিলেন, সেখানে ভগবান হয়ে নিজের মুখ থেকে নির্গত কথা কিভাবে বিফলে যেতে দিবেন?? এছাড়াও নারায়ণ শুধু কৃষ্ণরূপে নয়, যেকোনো রূপে পৃথিবীতে আসলে মহাদেব সেই নারায়ণের অবতারীরূপের কাছে একবার কেন হাজারবার পরাজিত হবেন।

কেননা, গাছ ফলের ভার গ্রহণ করে, ফল কখনও গাছের ভার গ্রহণ করতে পারে না। ঠিক সেইভাবে ভগবান মহাদেব গাছরূপে ভক্ত নারায়ণের ভক্তিতে ফলস্বরূপ ভক্তের ভার গ্রহণ করেছেন, কিন্তু ভক্ত নারায়ণ ফল হয়ে কখনও গাছরূপী ভগবান মহাদেবের ভার গ্রহণ করতে পারবেন না।

পরমেশ্বর ভগবানের মহাদেব বরদান দিয়েছেন এবং তা পৃথিবীর বুকে প্রতিফলিত করে দেখিয়েছেন, এইজন্যই তিনি দেবাদিদেব মহাদেব তথা পরমাত্মা পরমব্রহ্ম পরমেশ্বর ভগবান মহাদেব।

আশাকরি, কেন মহাভারতের মধ্যে কৃষ্ণনের সাথে যুদ্ধে পরমেশ্বর ভগবান মহাদেব পরাজয়ের গ্লানি নিয়েছেন তা এখন পরিস্কার হয়ে গেছে। এই পরাজয় ক্ষমতার নয়, এই পরাজয় ভক্তকে দেওয়া বরদায়ক প্রতিশ্রুতি রক্ষায়। কেননা, ভগবান দিতে জানে কিন্তু নিতে জানে না, আর ভক্ত নিতে জানে দিতে জানে না এবং পরমেশ্বর ভগবান মহাদেবের স্বীয় পরাজয়ে এটাও প্রমাণিত হয় যে, ভক্তের কাছে বাঁধা ভগবান কিন্তু ভগবানের কাছে ভক্তের কোনো বাঁধা বা বাধ্যবাধকতা নেই।

গৌড়িয় কৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সুবুদ্ধির উদয় হোক, প্রকৃত ভক্ত এবং ভগবান চিনুক ও পাপকার্য্য থেকে বেরিয়ে আলোর পথে ফিরে আসুক এই কামনায় করি.....

                               হর হর মহাদেব

Prepared by
Ashok Dev Nayon





Share This Article :

TAMBAHKAN KOMENTAR

7599550894000336510