পর্ব একঃ
আজকাল অনেক ইস্কনী বিশেষ করে কৃৈষ্ণবেরা বলে বেড়াচ্ছে পশুবলি নাকি কোনো শাস্ত্রেই নেই। এবার ইস্কনীরা যে সকল সাত্ত্বিক পুরাণকে হাতিয়ার করে, সেখান থেকেই রেফারেন্স সহ আপনাদের দেখাবো যে পশুবলি আছে কি নেই! তবে শ্লোকগুলিতে কোন তত্ত্বকথা খুঁজতে যাবেন না। যা বঙ্গানুবাদ সেটাই পড়বেন। হিসাব করলে শ্রীমদ্ভাগবতগীতার শ্লোকেরও অনেক ব্যাখা ও তত্ত্বকথা হয়। কই সেগুলো ত ধরেন না? যাই হোক সাত্ত্বিক পুরাণ থেকেই আগেই রেফারেন্স দেই, পরে ইস্কনী মতানুসারে ( এরা নিজেদের সাথে যা মিলবে সেটাই সাত্ত্বিক বাকীগুলো তামসিক। ধর্মের নামে নিজ মত প্রতিষ্ঠা আর গা জোয়ারি করলে যা হয় ) তামসিক , রাজসিক পুরাণ থেকে রেফারেন্স দেবো। প্রথমে দেখা যাক রাধাগোবিন্দ মন্দির গুলিতে যে ভাগবত পাঠ হয়, সেখানে কি লেখা-
তীর্থেষু প্রতিদৃষ্টেষু রাজা মেধ্যান্ পশূন্ বনে ।
যাবদর্থমলং লুব্ধো হন্যাদিতি নিয়ম্যতে ।।
( শ্রীমদ্ভাগবতপুরান... চতুর্থ স্কন্ধ... ষড়বিংশ অধ্যায়... শ্লোক- ৬ )
অর্থাৎ- যার মাংসের প্রতি অত্যাধিক আসক্তি আছে, সেই রাজা কেবলমাত্র শাস্ত্রনির্দিষ্ট কর্মের জন্য বনে গিয়ে প্রয়োজন মতো অনিষিদ্ধ প্রাণীকে বধ করতে পারেন , বৃথা প্রাণীহিংসা কোনোমতেই করবেন না- শাস্ত্রে এইভাবে ( নির্দেশ দিয়ে ) প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছে।
শ্লোক টা দেখুন। শাস্ত্র নির্দিষ্ট কর্মের জন্য পশু হত্যার বিধান আছে। যেহেতু এখন সরকার দ্বারা বন্য প্রানী হত্যা নিষিদ্ধ তাই সরকার দ্বারা স্বীকৃত পাঠা, ছাগ, মাছ খাওয়াই যেতে পারে। এই জন্য কালীসাধকেরা দেবীর ভোগের জন্য বলি দেওয়া পশুর মাংস দেবীকে নিবেদন করেন। সেটার রেফারেন্স ও সাত্ত্বিক পুরাণ থেকে দেবো। চলুন পরের শ্লোকে দেখি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে কি কর্ম করতে নারদ মুনি দেখেছিলেন-
চরন্তং মৃগয়াং ক্কাপি হয়মারুহ্য সৈন্ধবম্ ।
ঘ্নন্তং ততঃ পশূন্ মেধ্যান্ পরীতং যদুপুঙ্গবৈঃ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত... উনসপ্ততিতমহধ্যায়... দশম স্কন্ধ- ৩৫ )
অর্থাৎ- নারদ মুনি দেখলেন কোথাও তিঁনি ( ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ) শ্রেষ্ঠ যাদব পরিবৃত্ত হয়ে সিন্ধুদেশীয় অশ্বে আরোহণ করে মৃগয়া করছেন ও তাতে যজ্ঞ হেতু পশু সকল বধ করছেন।
যজ্ঞা হেতু পশু বধ দেখলেন। দেবী অম্বিকার আরাধনাও একটা যজ্ঞ। কারণ দেবীকে সুরা মাংস দিয়ে পূজা করার অধিকার স্বয়ং ভগবান দিয়েছেন। এবার দেখি ইস্কনীদের আর একটা সাত্ত্বিক পুরাণ “বিষ্ণুপুরাণে” কি লেখা-
সুরামাংসোপহারৈশ্চ ভক্ষ্যভোজ্যৈশ্চ পূজিতা ।
নৃণামশেষকামাংস্ত্বং প্রসন্না সম্প্রদাস্যসি ।।
( বিষ্ণু পুরাণ... পঞ্চম অংশ... প্রথম অধ্যায়... ৮৬ )
অর্থাৎ- দেবী! মদ ও মাংসের ভেট অর্থাৎ উপহার দিলে এবং ভোক্ষ্য- ভোজ্য পদার্থ দ্বারা পূজা করলে তুমি মানুষের সর্ব কামনা পূর্ণ করে দেবে ।
এবার ইস্কনীরা বলবেন না যে মদ খাওয়া খারাপ। হ্যা মাতাল হয়ে দেশীমদ খাওয়া খারাপ। নিয়মিত পরিমাণে দামী কোম্পানীর খেলে কোন ক্ষতি হয় না। বিশ্বাস না হলে যে কোনো ডাক্তারের পরামর্শ শুনতে পারেন। স্বয়ং বলভদ্র দেবও মদ খেয়েছিলেন। সাত্ত্বিক পুরাণ ভাগবত থেকেই দিচ্ছি রেফারেন্স-
গায়ন্তং বারুণীং পীত্বা মদবিহ্বললোচনম্ ।
বিভ্রাজমানং বপুষা প্রভিন্নমিব বারুণম্ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত... ১০ম স্কন্ধ... সপ্তষষ্টিতম অধ্যায়... শ্লোক- ১০ )
অর্থাৎ- তিনি বারুনী মদিরা পান করে মধুর সংগীতে মত্ত হয়েছিলেন। আনন্দোন্মাদে তাঁর নয়নযুগল বিহ্বল হয়েছিল। তাঁকে দেখে মদমত্ত গজরাজ মনে হচ্ছিল্ল ।
এবার ইস্কনীদের আর একটি সাত্ত্বিক পুরাণে “বরাহপুরাণ” এ কি লেখা আছে দেখা যাক। সেখানে বরাহদেব নিজমুখে কি বলছেন-
বরাহ উবাচঃ-
মার্গমাংসং ভরং ছাগং শাকং সমনুধুজ্যতে ।
এতান্ হি প্রাপণে দদ্যান্মম্ম চৈতৎ প্রিয়াবহম্ ।।
বুজানো বিততে যজ্ঞে ব্রাহ্মণে বেদপারগে ।
ভাগো মমান্তি তত্রাপি পশূনাং ছাগ্লস্য চ ।।
( বরাহ পুরাণ... উনবিংশত্যধিকশততমোহধ্যায় ... ১১-১২ )
অর্থাৎ- মৃগমাংস , ছাগ মাংস ও শসমাংস আমার অতি প্রিয় । সুতরাং এসব আমাকে নিবেদন করে দেবে। বিস্তৃত যজ্ঞে ছাগ ও অনান্য পশু দান করে বেদপারগ ব্রাহ্মণ কে সমর্পণ করলে আমি তাহার অংশভাগী হই।
মহিষং বর্জয়েন্মস্যং ক্ষীরং দধি ঘৃতং ততঃ ।
বর্জ্জয়েত্তত্র মাংসানি যজুষা বৈষ্ণবোহশ্নৃতে ।।
পরং পায়সপি বর্জ্যানি তন্মাংসং চেতক খুরে ।
পক্ষিণাঞ্চ প্রবক্ষ্যামি যে প্রযোজ্যা বসুন্ধরে ।।
( বরাহ পুরাণ... উনবিংশত্যধিকশততমোহধ্যায় ... ১৩-১৪ )
অর্থাৎ- আমাকে মহিষ মাংস , ক্ষীর, দৈ ও ঘি দান করতে হয়। কোনো কোনো বৈষ্ণবব্রতে মাংস দান করাও নিয়ম। হে বসুন্ধরা ! সম্প্রতি আমাকে যে সকল পাখীর মাংস আমাকে দিতে হয় তা উল্লেখ করছি, শ্রবন করো।
যে চৈব মম ক্ষেত্রেষু উপযুজ্যন্তি নিত্যশঃ ।
লাবুকং কার্ত্তিকঞ্চৈব প্রশস্তঞ্চ কপিঞ্জলম্ ।।
( বরাহ পুরাণ... উনবিংশত্যধিকশততমোহধ্যায় ... ১৫ )
অর্থাৎ- লাবক, কার্ত্তিক , কাপিঞ্জল ও অনেক প্রকার মাংস আমার কাজে প্রযুক্ত । যে সব দ্রব্য আমার কাজে দান করতে হয় তা বললাম।
উক্ত পুরাণে উক্ত অধ্যায়ে ১৬- ১৮ শ্লোকে লেখা- বরাহ দেব নিজ মুখে বলেছেন, "যাহারা এই নিয়ম বুঝে কার্য্য করে তাহারা কোনোভাবেই অপরাধী হয় না। ফলে ঐ সকল কথিত মাংস সকল ভোজ্য , মাঙ্গল্য ও ভক্তজনের সুখপ্রদ । যে ব্যাক্তি সিদ্ধি কামনা করে তাদের পূর্বোক্ত রূপে কাজ করা উচিৎ । এইরকম করলে আমার ভক্তেরা উত্তম সিদ্ধি প্রাপ্ত হয়"।
কি ইস্কনী বন্ধুরা ? মুরগী খেলে পাপ ? কিছু তথাকথিত ভক্ত এই বলি বিরোধিতা করেন, অথচ মাছের বাজারে লাইন, রবিবারে মাংসের দোকানে লাইন, ডিম টোষ্ট দিয়ে সকালের জলখাবার , দাওয়াত খাওয়াতে সবার আগে ছোটেন। হাতে “চিকেন রেজালা” নিয়ে ফটো আপলোড করেন। আচ্ছা ঐ সময় পশুবধে পশুদের কি কষ্ট হয় না ??? এবার দেখি বৈষ্ণবদের নয়নের মণি পরমসাত্ত্বিক পুরাণ ব্রহ্মবৈবর্ত্তে কি লেখা আছে –
মহিষেণ বর্ষশতং দশবর্ষঞ্চ ছাগলাৎ ।
বর্ষং মেষেণ কুস্মাণ্ডৈঃ পক্ষিভির্হরিণৈস্তথা ।।
( ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ... প্রকৃতিখণ্ড... চতুঃষষ্টিতমোহধ্যায়ঃ ... ৯৪ )
অর্থাৎ- দেবী দুর্গা মহিষবলি দিলে শতবর্ষ , ছাগল বলিতে দশ বৎসর , মেষ- কুস্মাণ্ড বলিতে এক বছর প্রসন্না থাকেন।
এখানে বলি দিলে দেবী সন্তুষ্ট হন না- এমন কোথাও নেই। এবার দেখি ইস্কনীদের আর এক সাত্ত্বিক “গরুড় পুরাণ” বলি নিষিদ্ধ নাকি স্বীকৃত বলা আছে-
জয় ত্বং কামভূতেশ সর্ব্বভূতলমাবৃতে ।
রক্ষ মাং নিজভূতেভ্যো গৃহ্ন নমোহস্তু তে ।।
( গরুড় পুরাণ... পূর্ব খণ্ড... অষ্টত্রিংশোহধ্যায়... ১৮ )
অর্থাৎ- ওঁ জয় ত্বং কামভূতেশে – ইত্যাদি মন্ত্রে সিংহবাহিনী মহিষমর্দিনীর দেবীকে বলিপ্রদানপূর্বক পূজা সমাপন করিবে।
পরের পার্টে ইস্কনীদের ঘোষিত তামসিক ও রাজসিক পুরাণ থেকে রেফারেন্স সহ লিখবো। কি ইস্কনী বন্ধুরা? এবারও কি বলবেন বলি প্রথা শাস্ত্র বিরুদ্ধ ? বলি আর হত্যার মধ্যে তফাৎ। হত্যা মানে নিজের উদর পূর্তি। শ্রীমদ্ভগবতগীতায় ভগবান বলেছেন- “যজ্ঞাবিশিষ্ট অন্ন যে ভোজন না করে সে চোর।” মাছ মাংস প্রসাদ রূপে গ্রহণের আগে সেটা শাস্ত্রীয় বিধিতে মহামায়াকে উৎসর্গ করতে হয়। তারপর প্রসাদ পেতে হয়। তা না করে উদর তৃপ্তির জন্য শুধু মাংস কেনো- মিনারেল ওয়াটার কিনে রাস্তাঘাটে পান করাও পাপ।
Thursday, April 30, 2020
Share This Article :
Emoticon