শৈব শাক্ত দের সঙ্গে কৈষ্ণবদের বিবাদ।
Tuesday, March 3, 2020
অনেকদিন ধরে শাক্ত-শৈব এবং বৈষ্ণবের (বলা ভালো, গৌড়ীয় বৈষ্ণবের) দ্বন্দ্ব নিয়ে ফেসবুক বেজায় সরগরম হয়ে উঠেছে। "শিব শক্তি বড় না কৃষ্ণ বড়" এই মীমাংসাহীন স্থূল তর্ক ছাড়াও, এইসব তর্কে অন্য একটি প্রসঙ্গও উঠে আসছে। সেটি হল, শাক্তের দৃষ্টিতে সাধনলক্ষ্য এবং ভক্তির সংজ্ঞা কী। কিছু উদ্দেশ্যপরায়ণ সাম্প্রদায়িক গৌড়ীয় বৈষ্ণব একটি কথা খুব বলে বেরোচ্ছেন যে, "শাক্তদের সাধনার আড়ালে কাজ করে থাকে সাধকের ক্ষমতার লোভ" "দেবীকে সর্বতন্ত্রস্বতন্ত্রা রূপে কল্পনা করে তাঁর সঙ্গে তাদাত্ম্য কামনা তারা এজন্যই করে থাকে, যাতে স্বয়ং তারা সর্বভোক্তা ঈশ্বরী হয়ে সক্কলের উপর ছড়ি ঘোরাতে পারেন" ইত্যাদি। এ জিনিস নতুন নয়, সাম্প্রদায়িক গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা অদ্বৈতবাদী দর্শনের এইরূপ স্থূল ব্যাখ্যা সচরাচর দিয়েই থাকে। যারা শাস্ত্রীয় শাক্তধর্ম এবং শাক্তের সাধনদর্শন সম্বন্ধে অবগত আছেন, তারা বুঝবেনই সেইসব বৈষ্ণবদের এই অভিযোগ কতটা হাস্যকর আর ভিত্তিহীন, এবং সর্বোপরি নিজেদের অজ্ঞতার প্রমাণ!
অদ্বৈতবাদের উপর ভিত্তি করে শাক্তদর্শনও অদ্বৈতবাদী। এবং বলা হয় শাক্ত অদ্বৈতবাদ আর এই দর্শনানুযায়ী, জীব স্বরূপত পরমশিব বা পরাশক্তি। এই পরমশিব বা পরাশক্তি নিজ মায়াশক্তি প্রভাবে নিজের নির্মল বিভু সত্তাকে আণব মলাবৃত করে, অণুত্ব প্রাপ্ত হয়। এই অণুত্বপ্রাপ্ত হয়ে পরমশিবই জীব রূপে আভাসিত। সাধনার দ্বারা জীব এই আণবমল অপসারিত করে পুনরায় নিজের পরমশিব স্বরূপে অধিষ্ঠিত হতে পারে। জীবের এই প্রত্যভিজ্ঞানই শাক্তদর্শনের মূলকথা। এবং শিবত্ব অর্জন করে আদ্যশক্তির সঙ্গে একাত্মতা লাভ করা l
পরমশিবত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একমাত্র পূর্ণাহং -ই অবশিষ্ট থাকে। পূর্ণাহং অর্থাৎ সেই পূর্ণ সামগ্রিক "আমি", যার বিপরীতে পৃথক কোনো দ্বিতীয় "আমি" নেই। অর্থাৎ, পরমশিব তাঁর দৃষ্টিতে ধূলিকণাতেও স্বয়ংকেই প্রত্যক্ষ করবেন, তাই তো আদ্যাশক্তি নিজেই বলছেন "একৈ বাহং জগৎতত্র দ্বিতীয়া কা মমা পরা "
অন্যান্য দেবদেবী যেমন হরি(বিষ্ণু), ব্রহ্মা, কৃষ্ণ, উষা, রাত্রি ইত্যাদির কথা তো বলাই বাহুল্য। এবার একটু বিচার করলেই বোঝা যাবে যে, পরমশিব বা পরাশক্তির সঙ্গে তাদাত্ম্যপ্রাপ্ত শক্তিসাধকের দৃষ্টিতে আত্মস্বরূপের বাইরে কিছুই না থাকার কারণে, শাক্তবাদ কে "ক্ষমতালোলুপতা" "ভোক্তৃত্বের লালসা" ইত্যাদি অভিযোগ কতোটা ভিত্তিহীন।আর এই ভিত্তিহীন কথাগুলোই এতকাল ধরে মানুষ কে ভুল বুঝিয়ে আসছে গৌড়ীয়রা !
এবার দেখা যাক শাক্তদৃষ্টিতে ভক্তির সংজ্ঞা কী। প্রথমেই বলি, ভিন্ন ভিন্ন সাধনপথ তৈরীই হয়েছে সাধকের ভিন্ন ভিন্ন রুচি ও ভাবকে ভিত্তি করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদৃষ্টিতে যেমন ঐশ্বর্য্যজ্ঞানরহিত রাগানুগা ভক্তির স্থান সর্বোচ্চ, শাক্তদৃষ্টিতে এবং শৈব দৃষ্টিতে জ্ঞানপুষ্ট ভক্তিই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ । বৈষ্ণবদৃষ্টিতে যেমন ঐশ্বর্য্যজ্ঞান শুদ্ধাভক্তির পথে বাঁধা; শাক্তদৃষ্টিতে জ্ঞানশূন্যা ভক্তি মোহের এবং মায়াবন্ধনের রূপান্তরমাত্র, এবং বৈষ্ণবশাস্ত্রে চরমভাবে গৌরবান্বিত 'মঞ্জরীভাব' শাক্তদৃষ্টিতে একেবারে নিম্নস্তরের প্রমাতা বিজ্ঞানকলের লক্ষণ, যাঁরা আণবমল জনিত আবরণের কারণে পূর্ণস্বাতন্ত্র্যে প্রতিষ্ঠিত হতে অক্ষম তারাই এই মঞ্জরীভাব অবলম্বন করে ।এই মতে অপরোক্ষ জ্ঞানের পরই প্রকৃত ভক্তির উদয় হয়। এর মধ্যে কোনটি সঠিক কোনটি নয়, এই সাম্প্রদায়িক বিচারই ভিত্তিহীন। কারণ আগেই বলেছি, সাধকের ভাবানুযায়ীই সাধনপথের এই আপাত ভিন্নতা।
তবে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, শক্তিসাধনার লক্ষ্য কি কেবলই তাদাত্ম্য লাভ, শাক্ত কি ভক্ত-সেবক হতে পারে না?বা সেব্য সেবকের সম্বন্ধ কি আসে না? নিশ্চয়ই পারে। তাদাত্ম্য লাভের পরও জীবন্মুক্ত সাধক কল্পিত উপাস্য-উপাসক ভেদজ্ঞান আশ্রয় করে নিজ আত্মার সেবা জ্ঞানে ইষ্টসেবা করতে পারে। এটি অদ্বৈত-ভক্তি নামে প্রসিদ্ধ। শাক্তদৃষ্টিতে এটিই পরাভক্তি। ত্রিপুরারহস্য জ্ঞানখণ্ড, দেবীভাগবত পুরাণোক্ত দেবীগীতা, মহাভাগবত ইত্যাদি এ সম্বন্ধে প্রমাণ। মহামহোপাধ্যায় গোপীনাথ কবিরাজ মহাশয়ও তাঁর একাধিক প্রবন্ধে এবিষয়ে আলোকপাত করেছেন। যোগীরাজ বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী মহোদয়ও এই বিষয়ে একই মত পোষণ করতেন।
এখন দেখা যাক, শ্রীদেবীগীতার ভক্তিযোগ অধ্যায় পরাভক্তির লক্ষণ সম্বন্ধে কী বলছে-
পরানুরক্ত্যা মামেব চিন্তয়েদ্যো হ্যতন্দ্রিতঃ।
স্বাভেদেনৈব মাং নিত্যং জানাতি ন বিভেদতঃ॥
মদ্রূপত্বেন জীবানাং চিন্তনং কুরুতে তু যঃ।
যথা স্বস্যাত্মনি প্রীতিস্তথৈব চ পরাত্মনি॥
চৈতন্যস্য সমানত্বান্ন ভেদং কুরুতে তু যঃ।
সর্বত্র বর্তমানাং মাং সর্বরূপাং চ সর্বদা॥
-যে ব্যক্তি অতন্দ্রিত হইয়া পরমপ্রেম দ্বারা নিয়ত আমারই(আদ্যশক্তির) ধ্যান করিয়া থাকে, যে ব্যক্তি আমাকে আপনার সহিত ভিন্ন না করিয়া "আমিই সচ্চিদানন্দরূপিণী ভগবতী" এইরূপ অভিন্ন জ্ঞান করে, যে ব্যক্তি অখিল জীবগণকে আমার স্বরূপ বলিয়া মনে করে, আর আপনাতে যেরূপ প্রীতি, পরমাত্মরূপিণী আমাতেও সেইরূপ প্রীতিবোধ করিয়া থাকে, চৈতন্যের সমানত্বহেতু যে ব্যক্তি সর্ব্বত্র বর্তমানা ও সর্ব্বরূপিণী আমার সহিত সর্ব্বদাই সর্ব্বজীবের অভিন্নত্ব জ্ঞান করে (সেই ব্যক্তিই পরাভক্তির অধিকারী)।
(সপ্তত্রিংশ অধ্যায়, শ্রীশ্রী দেবীগীতা)
সর্বজীব ও সর্ববস্তুতে আত্মাভিন্নতা জ্ঞান না হলে, ষড়রিপু, অষ্টপাশ না ঘুচলে, জীব কখনোই পরাশক্তিদেবীতাদাত্ম্য পেতে পারে না। তাই এই চূড়ান্ত অদ্বৈত দর্শনে ভোক্তৃত্বের লালসা কল্পনা করা, নিজের সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিজাত সংকীর্ণ দৃষ্টি এবং অজ্ঞানতারই পরিচয়। পরাসম্বিদ্রূপা দ্বৈতাদ্বৈতবর্জিতা মহাদেবীকে যারা নিজের মনোবৃত্তির মাপকাঠিতে বিচার করতে যাবে, তাদেরই হয়তো দেবীতাদাত্ম্য স্থূল "ভোক্তৃত্ব" বলে মনে হবে!
Prepared By
সঙ্কর্ষণ
Share This Article :
Emoticon