BLANTERVIO103

রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক নাথ ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস

রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক নাথ ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচারের ইতিহাস
Wednesday, April 28, 2021

 


বঙ্গীয় নাথ পদবীযুক্ত ব্যক্তিরা যে ব্রাহ্মণ বর্ণভুক্ত এবং এদের পূর্বপুরুষরা রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক নিপীড়িত হয়েছিল সে ইতিহাস বর্ণিত রয়েছে শ্রীযুক্ত গোপালভট্টবিরচিতম্ ও শ্রীযুক্তআনন্দভট্ট কর্তৃক পরিশিষ্টসহিতম্ "বল্লাল চরিত" নামক পুস্তকে। উক্ত পুস্তকের অনুবাদ করেন শ্রীশশিভূষণ ভট্টাচার্য্য মহাশয়।


রাজা বল্লাল সেন তার পিতার শ্রাদ্ধ দিবসে নাথ অর্থাৎ, রুদ্রজ ব্রাহ্মণদের দান দিতে গেলে রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা সে দান গ্রহণে অস্বীকার করেন। কারণ, রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা যোগ সাধনা করতো বিধায় শ্রাদ্ধে দান গ্রহণে অনাগ্রহী ছিল।

যাইহোক মূলপ্রসঙ্গে আসি, রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা বল্লাল সেনের পিতার শ্রাদ্ধের দান গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর দরুন বল্লাল সেন তাঁদের উপর অসন্তুষ্ট হন। তারপর একদা শিবচতুর্দশীতে জটেশ্বর মহাদেবের পূজায় রাজপুরোহিত বলদেব ভট্ট উপস্থিত হয়ে পূজার শেষে দানসামগ্রীতে ভাগ বসাতে চাইলে সেখানকার মন্দিরের পুরোহিত রুদ্রজ ব্রাহ্মণ যোগীরাজের সহিত কথা কাটাকাটি হয়। অতঃপর বলদেব ভট্ট রাজা বল্লাল সেনের নিকট বিচার দেন। নিজের পিতৃশ্রাদ্ধ দিবসে দান গ্রহণে রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা অস্বীকার করার কারণে পূর্ব থেকেই রাজা বল্লাল সেন এদের উপর অসন্তুষ্ট ছিল এবং তার উপর বলদেব ভট্টের অভিযোগ শুনে রাজা বল্লাল সেন ক্রোধে অন্ধ হইয়া যান।

"পূর্ব্বস্মাৎ স মহারাজো রুদ্রজান্ ব্রাহ্মণান্ প্রতি।

দানত্যাগার্দ্বীতরাগঃ স্বপিতৃশ্রাদ্ধবাসরে।।"

(বল্লাল চরিত, উত্তরখন্ডম্, শ্লোকঃ- ২১)


অতঃপর রাজা বল্লাল সেন ক্রোধান্বিত হইয়া বলিলেন,,"যারা এদের সহিত অর্থাৎ, রুদ্রজ ব্রাহ্মণগণের সহিত পূজাপৌরহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে সংযোগ স্থাপন করবে বা সাহায্য করবে তারা পতিত হবে। যার ফলে এদের যোগপট্ট, পৈতা ধারণ যোগিজাতির পক্ষে বৃথা হইবে।"

"যজনযাজনাদিকং, সাহায্য মাত্রং বা যে করিষ্যন্তি তেহপি পতিতা ভবিষ্যন্তীতি। অতএব, পট্ট সূত্রাদি ধারণং ব্যর্থম্।।" 

(বল্লাল চরিত, উত্তর খন্ডম্, শ্লোক ২৩ পরবর্তী দ্রষ্টব্য ) 


অতঃপর ক্রোধান্ধ রাজা কর্তৃক দন্ডিত হইয়া অনেক যোগীরা রাজ্যত্যাগ করল, কেউ কেউ গুপ্তভাবে অতিকষ্টে রাজ্যে বাস করিতে লাগলো। আর কতগুলো যোগী পৈতা'দি ত্যাগ করিয়া নানাবিধ জীবিকা গ্রহণ করিতে বাধ্য হইলো।


♦ প্রসঙ্গত, বর্তমানে অনেক ব্যানার্জী, চক্রবর্তী পদবীধারী ব্রাহ্মণদের মনে এই প্রশ্ন উঠতে পারে যেহেতু তৎকালীন যোগীজাতি তথা রুদ্রজ ব্রাহ্মণরা পৈতা ত্যাগ করেছিল তাহলে তো তারা পতিত হয়ে গেছে। তাহলে এখন তারা কি করে নিজেদেরকে ব্রাহ্মণ দাবী করে ?? 


→ এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলবো, ১৯৪৬ সালে যখন কলকাতায় লাগাতার দাঙ্গা হয়েছিল তখন অরাজক তত্ত্ব কর্তৃক তৎকালীন ব্রাহ্মণদের জোরপূর্বক গো-মাংস ভক্ষণ করানো হয়েছিল এবং নিজেদের মা-বোনদের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফলতঃ তখন তারা নিজেদেরকে পতিত ভেবে বসেছিল। কেননা শাস্ত্রানুযায়ী নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ ও নিজ মা-বোনদের সহিত সঙ্গমে লিপ্ত হলে ব্যক্তি পতিত হয়ে যায়।

অতঃপর পূজ্য ধর্মসম্রাট করপাত্রীজী মহারাজ সেখানে উপস্থিত হন এবং মনুসংহিতা থেকে 'বলাদত্তম' বচন উদ্ধৃত করে বলেন, যেহেতু আপনাদের বলপূর্বক করা হয়েছে অর্থাৎ, নিজের আত্মীয় স্বজনের জীবন বাঁচাতে গো-মাংস ভক্ষণ ও পরস্পরের মধ্যে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন, তাই শাস্ত্রানুসারে আপনারা পতিত হননি। তাই আপনারা সবাই পূর্বের ন্যায় এখনও ব্রাহ্মণ'ই আছে।


ঠিক একইভাবে পূজ্য ধর্মসম্রাট স্বামী করপাত্রী'জী মহারাজের মতোই মনুসংহিতা আদি শাস্ত্রানুসারে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সংস্কৃত কলেজের স্মৃতিশাস্ত্রের স্বনামধন্য অধ্যাপক বঙ্গগৌরব স্মার্তপ্রবর পূর্বভারতের পন্ডিত সমাজের প্রধান ভারতচন্দ্র শিরোমণি ভট্টাচার্য্যেণ স্বেচ্ছাচারী রাজা বল্লাল সেনের অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়নের দরুন পৈতা ত্যাগে বাধ্য হওয়া তৎকালীন যোগীজাতি অর্থাৎ, রুদ্রজ ব্রাহ্মণদের পুনরায় যজ্ঞপবীত সংস্কারের বিধি দিয়ে ভাষপত্র প্রদান করেন এবং উক্ত ভাষপত্রে তৎকালীন দেশদেশান্তরের বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণেরা হস্তাক্ষর করেন। দেশদেশান্তরের বিদগ্ধ ব্রাহ্মণ পন্ডিতবর্গের হস্তাক্ষর সম্বলিত ভারতচন্দ্র শিরোমণি ভট্টাচার্য্যের ভাষপত্রটি "যোগী সংস্কার ও আগম সংহিতা" নামক পুস্তকে লিপিবদ্ধ আছে।


★★ প্রসঙ্গত, অনেকের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে কেন যোগীজাতি তথা নাথদের রুদ্রজ ব্রাহ্মণ বলা হয় !

→ শাস্ত্রে বলা হয়েছে "ব্রাহ্মণস্য মুখমাসীৎ" অর্থাৎ, ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের জন্ম। 

সেই ব্রহ্মার মুখমন্ডলের ঊর্ধ্ব অংশ অর্থাৎ, ললাট থেকে একাদশ রুদ্রের উৎপত্তি।

আগম সংহিতায় বর্ণিত আছে, একাদশ রুদ্রের প্রধান ছিলেন 'মহান' এবং মহান রুদ্রের পুত্র ছিলো বিন্দু নাথ। এই বিন্দু নাথের বংশই হলো নাথ তথা যোগীজাতি। যেহেতু নাথদের পূর্বপুরুষ রুদ্র ছিলো তাই নাথদেরকে রুদ্রজ ব্রাহ্মণ বলা হয়।


★★ প্রসঙ্গত, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ তথা নাথরা 'শিবগোত্র' এবং প্রবর হলোঃ- শিব, শম্ভু, সরজ, ভূধর, আপ্নবৎ।


★★ "বল্লাল চরিত" গ্রন্থের টীকায় শ্রীশশিভূষণ ভট্টাচার্য্য নাথদের কার্য্যানুষ্ঠান সামবেদোক্ত বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন অর্থাৎ, নাথ'রা সামবেদীয় ব্রাহ্মণ।

তাছাড়াও সর্ব্বদর্শনাচার্য্য, কাব্য-তর্ক-বেদান্ত-ব্যকরণতীর্থ, তর্কভূষণ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনাচার্য্যের অধ্যাপক শ্রী বামদেব ভট্টাচার্য্য তাঁর "সামবেদীয় দশকর্ম্ম পদ্ধতি" নামক পুস্তকে সামবেদোক্ত গোত্র ও প্রবরদের তালিকায় শিবগোত্র উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত, সামবেদে কোন অব্রাহ্মণ নেই।


------- শেষ হইয়াও হইলো না শেষ -------- 


♦জানেন, নাথ তথা রুদ্রজ ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচারকারী রাজা বল্লাল সেনের সাধারণ কোন মৃত্যু হয়নি। কেননা শাস্ত্রেই বলা আছে, কেউ যদি ব্রাহ্মণ নিগ্রহ করে তবে তাকে এর কড়া মাশুল দিতে হয়। সেটা এই জন্মেই হোক কিংবা মৃত্যুর পর ঘোরতর নরকে পতিত হওয়ার মাধ্যমে।

"বল্লাল চরিত" পুস্তকের পরিশিষ্ট অংশে বল্লাল সেনের গুরু পীতাম্বর নাথের অভিশাপে অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে বল্লাল সেনের মৃত্যুর ঘটনা বর্ণিত রয়েছে। সেখানে বলা আছে,,,,,

বল্লাল সেন কর্তৃক অন্যায়পূর্বক নাথজাতিকে মানহীন করাতে পীতাম্বর নাথ তাঁর কয়েকজন স্বজাতি সহ অপমানানলে দগ্ধ হইয়া রাজাকে অভিশাপ দেন, "যেরূপ আমি স্বগণ সহিত অপমানালে দগ্ধ ও দন্ডিত হইলাম সেরূপ রাজাও স্বগণের সহিত জ্বলন্ত অগ্নিতে দগ্ধ হইবে। "

ইহার একবছর পরে দৈববশে বিক্রমপুরের অন্তর্গত রামপাল নামক গ্রামে বায়াদুম্ নামক এক ম্লেচ্ছ রাজা বল্লাল সেনের সাথে যুদ্ধ করতে আসেন। বল্লাল সেন যুদ্ধে যেতে উদ্যত হলে তার পত্মীগণ জিজ্ঞাসা করেন, যুদ্ধে যদি আপনার কোন অমঙ্গল ঘটে তবে আমাদের(পত্মীদের) কি গতি হইবে ?

বল্লাল সেন বলেন, " যদি আমার কোন অমঙ্গল হয় তবে এক জোড়া পায়রা দূত হয়ে তোমাদের নিকট উপস্থিত হবে। তাদের দেখলেই তোমরা চিতায় পড়িয়া আত্মাহুতি দিবে।"


যুদ্ধে রাজা বল্লাল সেন জয়লাভ করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণ যোগী পীতাম্বর নাথের অভিশাপ মাঝখানে চলে আসলো। অসাবধানত বল্লাল সেনের পায়রা দুটি রাজগৃহে ফিরে আসিল। তাহা দেখিয়া অন্তঃপুরবাসিনী রমণীগণ চিতানলে প্রাণত্যাগ করিল। অতঃপর রাজা বল্লাল সেন রাজ্যে এসে উক্ত ঘটনা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে নিজেকে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত করিয়া সকল সন্তাপ মোচন করলেন।


নমামি শঙ্কর 🚩

নমামি দুর্গে 🚩


✍️ লেখকঃ- অদ্রিব দেবনাথ, রুদ্রজ ব্রাহ্মণ, সামবেদীয়, কৌথুম শাখা ✍

Share This Article :

TAMBAHKAN KOMENTAR

7599550894000336510